প্রতিভার কাছে হার মানলো আর্থিক প্রতিবন্ধকতা। আরও ভালো অভিনয়ের জন্য ছেলে বেলা থেকে নিজের সাথে নিজে লড়ে এবার জাতীয় কলা উৎসবে যোগ দিতে দিল্লি পারি দিলো তিস্তা পারের সবজি বিক্রেতার কন্যা পুনম রায়। জমিদার বাড়ির গৃহবধূ থেকে সন্যাসী বিদ্রোহের নেত্রী। তিস্তা পাড়ে আজও জীবন্ত বঙ্কিমের সেই কিংবদন্তী চরিত্র দেবীচৌধুরানীকে যেনো নিজের জীবন থেকে উপলব্ধি করে ছিলো মেয়েটি। একক নাটকে এবার সেই দেবীচৌধুরানীকে উপস্থাপনা করতে দিল্লি পারি দিলো তিস্তা পারের কন্যা।
জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া তিস্তা পারের দক্ষিণ সুকান্তনগর কলোনীর বাসিন্দা পুনম রায়। জলপাইগুড়ি মারোয়ারী বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। মহিলা বিভাগে একক নাটক প্রতিযোগিতায় প্রথম হবার পর রাজ্যস্তরে আয়োজিত কলা উৎসবেও প্রথম হয়েছে সে। এবার ৮ থেকে ১১ই জানুয়ারি দিল্লিতে আয়োজিত জাতীয় কলা উৎসবে যোগ দিতে দিল্লি পারি দিলো পুনম। জলপাইগুড়ি মারোয়ারী বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর ছাত্রীর এই কৃতিত্বে গর্বিত স্কুল কর্তৃপক্ষও। পুনমের বাবা সঞ্জীব রায় সবজি বিক্রেতা। একা আয়ে ৬ জনের সংসার নিদারুণ আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে চলে। সঞ্জীব বাবুর মেয়ে পুনম ছেলেবেলায় তার মা কুশল রায়ের কোলে শুয়ে শুনতো তিস্তা পারে দেবী চৌধুরানীর আনাগোনার গল্প। কিভাবে দেবীচৌধুরানী আর্তের পাশে দাঁড়াতেন সেই গল্প শুনে বিভিন্ন উৎসবে অনুষ্ঠানে বারে বারে পরিবারের সঙ্গে ছুটে যেতো বৈকন্ঠপুর অঞ্চলের শিকারপুরে চা বাগানে থাকা ভবানী পাঠকের ডেরায়। কিংবা কখনও যেতো জলপাইগুড়ি গোশালা এলাকায় থাকা দেবী চৌধুরানীর স্মৃতি বিজড়িত মন্দিরে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেবীচৌধুরানী সেজে অভিনয় করতো। এখন সেই বীরাঙ্গনার চরিত্রই একক নাটকের মাধ্যমে দিল্লির বুকে মঞ্চস্থ করবে পুনম। আর এতেই খুশির হাওয়া তিস্তা পারে।
পুনম রায় বলেন, তার কোনও পেশাদারি প্রশিক্ষণ নেই। কারণ প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো তাদের সামর্থ নেই। কারন বাবা সামান্য সবজির দোকান করে তিন ভাইবোনের যাবতীয় খরচ খরচা চালাচ্ছেন। কিছুদিন আগে স্কুল থেকে রাজ্যস্তরের কলা উৎসবে অংশ গ্রহণ করানোর জন্য উদ্যোগী হন স্কুলের শিক্ষিকারা। তমালিকা দত্ত ও পারমিতা দত্ত ম্যাডামরাই লাগাতার প্রশিক্ষণ দিয়ে একাঙ্ক নাটকের জন্য প্রস্তুত করেছেন। কিভাবে মাত্র ছ’ মিনিটের মধ্যে নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে, ডায়লগ, এক্সপ্রেসন সমন্বয় রক্ষা হবে, কিভাবে তার যাবতীয় কৌশলও তারাই শিখিয়ে দেন। সেই মতোই অনুশীলন চালিয়েছেন। তাতেই কাজ হয়েছে।
এদিকে মেয়ের সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত গোটা পরিবার। তবে সে যে একেবারে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পাবে, তা যেন এখনও বিশ্বাসই করতে পারছেন পুনমের বাবা সঞ্জীব রায়, মা কুশল রায়। তাঁরা বলেন, “ও ছোট বেলায় একটু নাচ শিখেছিল। আমি তো ওকে অভিনয়ের কোনও প্রশিক্ষণ দিতে পারিনি। এর জন্য ওর স্কুলের অবদানই প্রধান। ওরা না থাকলে হয়তো মেয়ে এই সাফল্য পেতো না। ওর এই গুণের কথা আমরা জানতেও পারতাম না। রাজ্যে চ্যাম্পিয়ন হবার পর এবার জাতীয়স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাচ্ছে। পাশাপাশি মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমদের আশা ও নিশ্চই সাফল্য পাবে।”
স্কুলের টিচার ইনচার্জ রিমা তেওয়ারি বলেন, অত্যন্ত দুঃস্থ পরিবার থেকে উঠে এসেছে অত্যন্ত প্রতিভাবান এই মেয়েটি। এদের ‘দিন আনি, দিন খাই’ পরিবারে অভিনয় নিয়ে ভাবাটাই যেখানে বাতুলতা সেখানে এর পরিবার অত্যন্ত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের স্কুলের শিক্ষিকারাও একে অনেক তালিম দিয়েছে। যার পরিনাম দিল্লি পারি দেওয়া। এই ঘটনায় আমাদের স্কুলের প্রত্যেকে গর্বিত অনুভব করছে। পুনমকে দেখে আরও অন্যান্য ছাত্রীরাও অনুপ্রাণিত হউক এই কামনা করি। পুনম রায়ের সাফল্যে গর্বিত ডি আই জলপাইগুড়ি বালিকা গোলে। তিনিও পুনমকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।