স্বাধীনতার ৭৫ টি বছর সম্পূর্ণ! আজ থেকে ৭৬ বছর আগে পরাধীনতার গ্লানি মুছে, ব্রিটিশ-শাসন মুক্ত হয়ে বিশ্ব মানচিত্র নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি – ভারত । ভারতবাসীর ওপর ব্রিটিশ শোষণ-নির্যাতনের, অকথ্য অন্যায়-অত্যাচারের, সীমাহীন বঞ্চনার শেষ দিনটি ছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পরদিন আসে ভারতবাসীর বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা। ১৬ আগস্ট লালকেল্লায় লাহোরি গেটের উপর প্রথমবারের মতো উত্তোলিত হয় তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা। সেই দিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে আকাশে উদিত রামধনু নতুন ভারতকে যেন সাতরঙা স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, “সারা বিশ্ব যখন ঘুমাবে ভারতবর্ষ জেগে উঠবে নিজের মহিমায়”। স্বাধীনতা লাভের মাহেন্দ্রক্ষণের সেই চিত্র আজও আবেগাপ্লুত করে তোলে প্রতিটি ভারতবাসীর হৃদয়। কারণ, এই স্বাধীনতা ছিল কষ্টার্জিত স্বাধীনতা, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং অগণিত প্রাণের বলিদানে অর্জিত স্বাধীনতা।
ভারত প্রায় দুই শতাব্দী ধরে মাতৃভূমি, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। এই সুদীর্ঘ লড়াইয়ে ভারতমাতা-র বীর সন্তানেরা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কখনই পরিত্যাগ করেননি। সাময়িক জয়ে আত্মহারা হয়ে কিম্বা পরাজয়ে মুষরে পড়ে তারা কখনই থেমে থাকেননি, মনের মন্দিরে সযত্নে লালন করে আসা স্বাধীনতার আর্তিকে তাঁরা কখনও ফুরিয়ে যেতে দেননি। কারণ ভারত হলো ‘বহুরত্না বসুন্ধরা’! স্বামীজি-নেতাজি-গান্ধিজি-নেহেরু-ভগৎ-আজাদ-প্যাটেলের দেশ এই ভারত, তাঁর এই বীর সন্তানেরাই তো ভারতের স্বাধীনতার মূল কান্ডারী। ভারতের মাটিতে ইংরেজ শাসনের সূচনা থেকে স্বাধীনতা লাভের পূর্বলগ্ন পর্যন্ত অজস্র স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম আমরা খুঁজে পাই ইতিহাসের পাতায়, যারা দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃংখল মোচনে আমৃত্যু লড়াই করে গিয়েছেন কিংবা এই লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু আজও হয়তো ভারতের কোনো প্রান্তে অনালোচিত হয়ে নিভৃতবাসে জীবন অতিবাহিত করছেন কোনো নির্ভীকচিত্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী কিংবা তাদের পরিবার, যাঁদের নাম হয়তো বা ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ তাঁরাও একদা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এমনকি নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করতেও কখনো কুন্ঠাবোধ করেননি। অচর্চিত হলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাদের অবদান কি কখনো অস্বীকার করা সম্ভব?
আসমুদ্রহিমাচলে মহাসমারহে ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ উদযাপিত হচ্ছে। ভারতবাসী হিসেবে এই মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে পেরে নিঃসন্দেহে আমরা গর্বিত। কিন্তু যাদের জীবনপাত করা সংগ্রামের ফলশ্রুতি এই স্বাধীনতা, তাদের প্রত্যেককে কি আমরা যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছি? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এই প্রশ্ন কিন্তু আমাদের গভীর পীড়া দেয়। যা আমাদের ব্যর্থতাকেই বারবার প্রকট করে তোলে। স্বাধীনতার পর এই সুদীর্ঘ ৭৫ বছরে সরকার বাহাদুর কেন কোন সরকারি উদ্যোগ নিলেন না প্রত্যন্ত থেকে প্রত্যন্ত স্থানের স্বাধীনতা সংগ্রামী কিংবা তাদের পরিবারকে খুঁজে বের করবার ? আজও সরকারিভাবে আমাদের কাছে কোন জেলাভিত্তিক কিংবা রাজ্যভিত্তিক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কোনো তালিকা নেই। এই ব্যাপারে যা কিছু তা তথ্য পাওয়া যায়, তা নিতান্তই স্থানীয় গবেষকদের নিরলস পরিশ্রমের ফসল। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সর্বোচ্চ সময়। একেবারে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তর অথবা পৌরসভা স্তর থেকে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যথার্থ গবেষণার মাধ্যমে অনুসন্ধানের উদ্যোগ অতি দ্রুত গ্রহণ করা প্রয়োজন। না হলে হয়তো বা কোন স্বাধীনতা সংগ্রামী হারিয়ে যাবেন কালের অতল গহ্বরে। প্রয়োজনে আশু জনগণনা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে দেশের অভ্যন্তরে এই মহান কাজ সুসম্পন্ন করতে হবে। বিদেশের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব পালন করা উচিত বিদেশ মন্ত্রকের। যে দেশে জনগণনার জন্য সরকার দ্বারে দ্বারে যেতে পারে এবং কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করতে পারে সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কি আজও উপেক্ষিত থেকে যাবেন ? আর যদি তাই হয় তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না।
শঙ্খনাদ আচার্য
সহকারী শিক্ষক
গোপালনগর এম এস এস হাই স্কুল (উঃ মাঃ)
দিনহাটা, কোচবিহার ।