Heritage Of Dinhata:শতাব্দী প্রাচীন বুড়ীমাতার পুজো প্রকৃত  অর্থেই  সম্প্রীতির উৎসব

শঙ্খনাদ আচার্য্য

ইদানীংকালে বৈদ্যুতিন মাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম কিংবা খবরের কাগজের পাতায় যখন আমরা ধর্মীয় জিগির, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, বিদ্বেষ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের নানা সংবাদে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি তখন তার ঠিক উল্টো দিকে হেঁটে কোচবিহার জেলার প্রান্তিক মহকুমা শহর দিনহাটার মানুষ শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য (Heritage Of Dinhata) বজায় রেখে আশ্বিনের সংক্রান্তিতে মেতে ওঠেন ‘সম্প্রীতির উৎসবে’। সড়কপথে কোচবিহার থেকে দিনহাটা শহরে প্রবেশের ঠিক মুখেই অবস্থিত পুঁটিমারী গ্রামে গড়ের উপরিস্থিত  মন্দিরের বনদুর্গা পুজো কে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে এই উৎসবের আবহ। তবে  স্থানীয়ভাবে এই পুজো বুড়ীমাতার পুজো নামেই সমধিক পরিচিত। বুড়ীমাতার পুজো অন্যান্য পুজোর মতো নিছকই পুজো নয়, সূচনালগ্ন থেকেই এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দু- মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির উজ্জল ঐতিহ্য।

                এই বুড়ীমাতার পুজোর প্রচলণ ঠিক কবে হয়েছিল তার ঐতিহাসিক বিবরণ না থাকলেও জনশ্রুতি থেকে জানা যায় আনুমানিক ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায়  ১৩৮ বছর আগে এই পুজোর সূচনা করেন স্থানীয় কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ। জনশ্রুতি অনুসারে কোচবিহারে রাজ- শাসনকালে  পুঁটিমারীর তিন বন্ধু শ্রীনাথ রায় বর্মা, আসমৎ আলী বক্সী ও হেমানন্দ বক্সী গড়ের ওপর দুর্গা পুজোর সূচনা করেন। পুজো সমাপনের কিছুদিন পর শ্রীনাথ রায় বর্মা স্বপ্নাদেশ পান -” দশভূজা নয় , দেবীকে এখানে বনদুর্গা রূপেই পুজো করতে হবে “।

পরের  বছর আশ্বিনের সংক্রান্তিতে শুরু হলো বনদুর্গার পুজো। সেই থেকে আজও ওই একই দিনে, একই নিয়ম- নিষ্ঠায় পূজিতা হয়ে আসছেন বনদুর্গা। স্বপ্নাদেশে দেবীর যে মূর্তী পাওয়া যায় সেই রূপেই দেবী এখানে পূজিতা  হন। দেবী এখানেও সিংহবাহিনী , কিন্ত দেবী এখানে বৃদ্ধা, মাথার চুল পাকা। দুই হাত বিশিষ্টা দেবীর বাঁ দিকের কোলে রয়েছে  একটি শিশু এবং ডান হাতে দেবী আশীর্বাদরতা ভঙ্গিমায় বিরাজমান। সেইআমলে ভেটাগুড়ি নিবাসী লোকনাথ মালাকার প্রথম মায়ের এই মূর্তী নির্মাণ করেন এবং তাঁরই বংশধরেরা আজও সেই পরম্পরা বজায় রেখেছেন। সুদূর অসম নিবাসী দেবনাথ দেবশর্মা এই পুজোর প্ৰথম পূজারী ছিলেন এবং বংশানুক্রমে দেবশর্মা পরিবার-ই প্রত্যেক বছর এই পুজো করে চলেছেন।

burimatar murti heritage of dinhata
বুড়ীমাতার মুর্তি

             দেবী এখানে বৃদ্ধারূপে পূজিতা হন বলেই ‘বুড়ীমাতা’ নামেই লোকমুখে পরিচিত। তবে এ বিষয়ে “উত্তরের লোকায়েত সমাজে শিব চন্ডিকার বৈচিত্র” গ্রন্থে রমণী মোহন বর্মা লিখেছেন- ” শিবের লৌকিক নাম বুড়া আর তাঁর স্ত্রীর  লৌকিক নাম বুড়ী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই ত্রিশক্তির আধার হলেন পার্বতী। পার্বতী এখানে বুড়ী, শিবের স্ত্রী । মানবসমাজ বিপদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে, পার্বতীর মন জয় করতে, কৃপাধন্য হতে উত্তরবঙ্গে শুরু হয় বুড়ী পুজো। শিবভক্ত রাজবংশী জনগোষ্ঠীতে লোকদেবী বুড়ীর প্রভাব রয়েছে “। বহু গবেষক মনেকরেন  মূলত সন্তান লাভের আশায় এই অঞ্চলে বুড়ীমাতার আরাধনার প্রচলণ হয়।(Heritage Of Dinhata)

                 হিন্দু- মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের যৌথ উদ্যোগে শুরু হওয়া শতাব্দী প্রাচীন এই বুড়ীমাতার পুজো প্রকৃতঅর্থেই সম্প্রীতির উৎসব। আজও দুই সম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধে- কাঁধ মিলিয়ে মহাসমারোহে পুজোর আয়োজন করেন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বর্তমানে দুই সম্প্রদায় মিলিয়ে মোট ৪০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত পুজো কমিটিকে পুজোর কোনো খরচই বহন করতে হয় না। কেন না এখানে মানতকারীদের সুদীর্ঘ তালিকা  রয়েছে । তাঁরাই পুজোর খরচ অর্থাৎ মায়ের মূর্তী, পুজোর সামগ্রী ও বাদ্যকারের খরচ যোগান।

কমিটিসুত্রে জানা যায় ২০৫৭ সাল পর্যন্ত মানতকারীদের তালিকা  তৈরি রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় এই বুড়ীমাতার ওপর স্থানীয় অধিবাসীদের শ্রদ্ধা ও আস্থা কতটা গভীর। বহু মানতকারী এই পুজোয় মায়ের নামে পায়রা ও পাঁঠাও উৎসর্গ করেন। প্রতি বছর আশ্বিনের সংক্রান্তিতে দেবীর বার্ষিক পুজোকে কেন্দ্র করে মন্দির সংলগ্ন প্রাঙ্গণে  পাঁচদিন ব্যাপী মেলাও বসে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন মেলার জন্য ২২ শতক জমি বুড়ীমাতার নামে দান করেছেন আসমৎ আলীর পুত্র ইয়াকুন উদ্দিন মিঞা- যা কিনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির। মেলাপ্রাঙ্গণস্থিত মুক্তমঞ্চে  ওই দিনগুলোতে আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,যার মধ্যে উল্লখযোগ্য হলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসা উত্তরের লোকসংস্কৃতির অঙ্গ- কুষাণ গান। কেবলমাত্র এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের খরচ পুজো কমিটিকে বহন করতে হয়। (Heritage Of Dinhata)

                বছরভর এই মন্দিরে ধর্মপ্রাণ মানুষের ভিড় লেগেই থাকে,তবে বুড়ীমাতার বার্ষিক পুজো উপলক্ষে মন্দির ও সংলগ্ন মেলা প্রাঙ্গণে  দূর- দূরান্ত থেকে ভিড় জমান অগণিত দর্শনার্থী। ধর্ম- বর্ণ- বিত্তের ভেদাভেদ ভুলে ওই দিনগুলোতে পুজো প্রাঙ্গণ পরিণত হয় মানুষের এক মহামিলন ক্ষেত্রে।

লেখক পরিচিত

দিনহাটার সম্প্রীতির পীঠস্থান বুড়িমাতা মন্দির নিয়ে এই লেখাটি লিখেছেন বিশিষ্ট শিক্ষক শঙ্খনাদ আচার্য্য। তিনি গোপালনগর এম এস এস হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক ।শিক্ষকতার পাশাপাশি দিনহাটা মহকুমার পুরাকীর্তি সংরক্ষণের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন তিনি । ২০০৮ সাল থেকে কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সাথে যুক্ত তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *