‘রাজনগর’ কোচবিহারের উৎসবমুখর দিনগুলির তালিকায় অন্যতম হলো রথযাত্রা(Rathyatra) উৎসব। রাজকীয় ঐতিহ্য এবং পরম্পরায় ভর করে আজও কোচবিহারের রাজপথে এগিয়ে চলে রথের চাকা। তবে রথযাত্রা বলতেই আমাদের মনের ক্যানভাসে যে অতি পরিচিত দেব-দেবীর ছবি ভেসে ওঠে, কোচবিহারের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রায় কিন্তু সেই ছবি দেখা যায় না। রাজনগর এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। অর্থাৎ জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা নন, এখানে রথের আরোহী হন কোচবিহারবাসীর প্রাণের ঠাকুর ‘মদনমোহন’। সেই দিক থেকে কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরের রাজকীয় রথযাত্রা সত্যিই অনন্য।
আধুনিক কোচবিহারের রূপকার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুরের রাজত্বকালে শহরের প্রাণকেন্দ্রে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ শুভ উদ্বোধন হয় মদনমোহন মন্দিরের। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিবছর কোচবিহার শহরে মহাসমারোহে পালিত হয়ে আসছে মদনমোহন দেবের এই রথযাত্রা(Rathyatra)। বৈরাগী দিঘির পাড়ে অবস্থিত শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরে মদনমোহনের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে দু’টি বিগ্রহ রয়েছে। বড় বিগ্রহটি ভক্তদের কাছে ‘বড়বাবা’ নামে পরিচিত। আর ছোট বিগ্রহটি পরিচিত ‘ছোটোবাবা’ নামে। রথযাত্রার দিন রথে চেপে ২ কিলোমিটার দূরে ‘মাসির বাড়ি’ গুঞ্জবাড়িস্থিত ডাঙ্গরাই মন্দিরে পৌঁছে যান ‘বড়বাবা’। রথ থেকে উল্টো রথের দিন ‘বড়বাবা’ না ফেরা পর্যন্ত মন্দিরের মূল সিংহাসনে আসীন থাকেন ‘ছোটবাবা’। রাজআমল থেকেই এই পরম্পরা পালিত হয়ে আসছে।
রীতি মেনে রথযাত্রার আগের দিন হয় অধিবাস। সুগন্ধী তেল মাখিয়ে চলে মদনমোহনের অঙ্গরাগ পর্ব। পরদিন থাকে মদনমোহনের মহাস্নান। রথযাত্রার দিন মূল মন্দিরের পশ্চিম দিকে কাঠামিয়া মন্দিরে স্থানান্তরিত করা হয় মদনমোহনকে। সেখানেই বিশেষ পুজো হয়। পুজোয় পঞ্চ ব্যাঞ্জন, পরমান্ন, লুচি প্রভৃতি দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে হয় যজ্ঞ। দুপুরের আহার শেষে একটু বিশ্রাম। ততক্ষণে মদনমোহন ঠাকুরবাড়ির সামনে মাসির বাড়ি থেকে চলে আসে সুসজ্জিত রথ। এরপর মদনমোহনকে রথে বসানো হয়। মন্দিরের দ্বিতীয় গেট দিয়ে বের হয় রথ। রথের দড়িতে দুয়ারবক্সি টান দিয়ে রথযাত্রার সূচনা করেন। তবে শোনা যায় রাজ-শাসনে মহারাজারাই রথের সূচনা করতেন।
এবার আসা যাক রাজকীয় ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক রথটির কথায়। ১৮৯০ সালে মদনমোহন মন্দিরের রথযাত্রা(Rathyatra) উৎসব শুরু হবার পর থেকে রথটি কিন্তু অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। কিছু সংস্কার এবং কাঠ বদল করা ছাড়া রথটির বিশেষ কোন পরিবর্তন করা হয় নি। ছ’টি চাকাবিশিষ্ট রথটির উচ্চতা ২২ ফুট। সামনে রয়েছে দু’টি রুপোর ঘোড়া। সারথিরা কাঠের। মন্দিরেই ফি বছর প্রায় ৪০ কেজি পাট দিয়ে তৈরি হয় রথের দড়ি। রথের শোভাযাত্রায় অংশ নেন কীর্তন দলের সদস্যরা। আর রথের দড়ি ধরতে জনজোয়ারে ভেসে যায় কোচবিহারের রাজপথ। শোনা যায় রাজআমলে রথের পুরোভাগে ‘পাট হাতি’ ( পিলখানার সর্বশেষ্ঠ্য হাতি ) থাকত। সুসজ্জিত হাতিটিকে নিয়ে একজন মাহুত নির্দিষ্ট যাত্রাপথ ধরে সামনের দিকে এগোতেন। সেই সময় রথের সামনে রাজার সেনা ও রাজকীয় ব্যান্ডও থাকত। সব মিলিয়ে তৈরি হতো এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আবহ।
সুনির্দিষ্ট পথে শহর পরিক্রমা করে শতবর্ষ অতিক্রম করা এই রথটি। পরিক্রমা শেষে মাসির বাড়ি ‘গুঞ্জবাড়ি’তে সাত দিন থেকে উল্টো রথের শেষে আবার মন্দিরে ফিরে এলে মদনমোহনকে বারান্দায় রাখা হয়। এবার ঠাকুরের বিশ্রামের পালা। এই রীতিটি ‘ঠাকুরের হাওয়া খাওয়া’ নামে প্রচলিত। এই সময় তাঁকে বিশেষ ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয় শুধুই রসগোল্লা। এরপর সিংহাসনে গিয়ে বসেন কোচবিহারের মহারাজাদের কুলদেবতা। রাজা নেই, নেই রাজ্যও, তবু কোচবিহারের রাজ পরিবারের কুলদেবতা মদনমোহন দেবের শতাব্দী প্রাচীন রথযাত্রাকে(Rathyatra) ঘিরে উৎসাহ, উদ্দীপনা রয়ে গেছে আগের মতই। কারণ এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোচবিহারের মানুষের আবেগ। তাই রাজকীয় ঐতিহ্য ও পরম্পরা ধরে রাখবার তাগিদে এতটুকু মরচে ধরে নি।
শঙ্খনাদ আচার্য
সহকারী শিক্ষক
গোপালনগর এম এস এস হাই স্কুল
দিনহাটা, কোচবিহার
চলভাষ – ৯৫৪৭২০৫৩৩৮